শ্রী শ্রী চণ্ডীতে আছে,
“নমো নমো মা দুর্গা
নমো নারায়ণী
কখনও বা পুরুষ হও
কখনও রমণী।
রাম রূপে ধর ধনু মা
কৃষ্ণরূপে বাঁশি,
ভুলালি শিবের মন
হয়ে এলোকেশী”।
শাস্ত্রে শ্রী শ্রী দুর্গা দেবীর অনেক নামের মধ্যে মহাশক্তি, ব্রহ্মময়ী, আদ্যাশক্তি, নারায়ণী, চণ্ডী, মহিষ-মর্দিনী, অশুর নাশিনী- এই সকল নাম বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। এই নামগুলির প্রত্যেকটি অর্থের মাঝে একটি দর্শন, একটি তত্ত্ব নিহিত আছে। দুর্গা শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ দুর্গতি-নাশিনী। এই দুর্গাপূজাকে গ্রামের সাধারণ মানুষ বড় পূজা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। সুতরাং আর্য ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব হল এই দুর্গোৎসব। এখন এই দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের প্রকৃত তত্ত্ব কী এটাই এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়। এখানে পূজা শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে-“যা করলে জীবনে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়”। পূজা শব্দটি এসেছে পূজ ধাতু থেকে। এই পূজ ধাতুর অর্থ হচ্ছে ‘বর্দ্ধনশীলতা’। উৎসব শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘উৎস অভিমুখে গমন’ অতএব পূজা বা উৎসব শব্দটি একই অর্থ বহন করে। এই দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের মধ্যে দু’টি তত্ত্ব নিহিত আছে। একটি জাগতিক বা সাংসারিক এবং অন্যটি আধ্যাত্মিক। এ পূজার জাগতিক অর্থ হল বাস্তব জীবনের উন্নয়ন। দুর্গাপূজা করা মানে হচ্ছে দুর্গা হওয়া। দুর্গার দশটি হাতের অর্থ হল দশদিকের কর্মযোগ্যতা বা দক্ষতা। একজন নারী যখন সংসারের সকল কর্মে দক্ষতা লাভে ব্রতী হয় তখনই তার সংসার সুন্দর হয়। আর সুন্দর সংসার হতে হলেই লক্ষ্মী-সরস্বতীর মত কন্যা এবং গণেশ-কার্তিকের মত পুত্র হওয়া বাঞ্চনীয়। আর সুন্দর সন্তান জন্মাতে প্রয়োজন স্বামীর প্রতি অবিচ্ছেদ্য টান। শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বলেছেন, “স্বামীর প্রতি টান যেমনি, ছেলেও জীবন পায় তেমনি”। তাই দুর্গাপূজার শিবঠাকুর দেবীর মাথার উপরে। তাই বলেছেন,
স্বামী রেখে মাথার উপর
ইষ্ট পূজায় জীবন শেষ
সতী-তেজের বর্ম নিয়ে
এরাই গড়বে নূতন দেশ”।
দুর্গার দশটি হাতের মধ্যে একটি আশির্বাদের অভয় হস্ত এবং বাকী নয়টিই হচ্ছে প্রহরণ যন্ত্র। এই নযটি প্রহরণ যন্ত্র দিয়ে মহা শক্তি জগতের অমঙ্গলকে ধ্বংস করবে। তাই প্রতিটি মা যদি জীবন্ত দুর্গা না হয়ে ওঠে তবে এ পূজার সার্থকতা কোথায়? মাটি দিয়ে গড়া এ প্রাণহীন প্রতিমাকে তাই পুরোহিত মন্ত্রপুত করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে, চক্ষুদান করেন। তেমনি প্রতিটি নারীর মাঝে ইষ্টমন্ত্র বা দীক্ষাদান পূর্বক নূতন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও জ্ঞান চক্ষুদান করে জগতের দুর্গতি নাশে যত্নবান হলেই আমাদের এ দুর্গাপূজা সার্থক হবে। সংসার যখন দুর্গা-মণ্ডপে পরিণত হবে তখনই হবে এ পূজার সার্থকতা। নতুবা মাটির পূজা মাটি হয়েই যাবে।
সঞ্জয় মল্লিক
লেখক : চারণ কবি ও কলেজ শিক্ষক
No comments:
Post a Comment